অশোক সেনগুপ্ত, আমাদের ভারত, ২৬ মে: রবীন্দ্র সরোবরে দুর্ঘটনার দায় এড়াতে পরিবেশবাদীদের ঘাড়ে দোষ চাপানোর প্রবণতার কড়া সমালোচনা করলেন প্রবীন পরিবেশ প্রযুক্তিবিদ সোমেন্দ্র মোহন ঘোষ। বৃহস্পতিবার তিনি এই প্রতিবেদককে স্পষ্ট জানান, “প্রশাসন এবং সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন পক্ষ পর্যাপ্ত সতর্কতামূলক ব্যবস্থা না নিয়ে পরস্পরের দোষগুণ বিচার করতে থাকলে অচিরেই দক্ষিণ কলকাতার ফুসফুস স্তব্ধ হয়ে যাবে।
সোমেন্দ্র মোহনবাবু বলেন, “প্রথমেই বলি পরিবেশবাদী হিসেবে আমি লজ্জা পাই যখন দেখি অন্য এক পরিবেশপ্রেমী ইচ্ছাকৃতভাবে অপর এক পরিবেশপ্রেমীকে সমাজে অজ্ঞ হিসেবে প্রতিপন্ন করার আপ্রাণ চেষ্টা করেন। আমার মনে হয় এই কারণেই সুপরিবেশের জন্য দাবি দাওয়াগুলো আস্তে আস্তে স্তিমিত হয়ে আসছে। জানিনা অনেক ক্ষেত্রেই মনে হয় এর পেছনে আত্মম্ভরিতা না বিশেষ উদ্দেশ্য কাজ করে?
দিন চার আগেই রবীন্দ্র সরোবরে নৌকাবাইচ অনুশীলনের সময় একটি মর্মান্তিক দুর্ঘটনায় দুটি কচি প্রাণ চলে গেল। যখন কোনও দুর্ঘটনা ঘটে যায় তার পরেই বিচার করে মানুষ কিভাবে এটি ঘটল আর তা কিভাবে এড়ানো যেত। স্বাভাবিক ভাবেই এক্ষেত্রেও প্রচারমাধ্যমের সামনে বিভিন্ন মতামত উঠে এল। কার দোষ কার গাফিলতি সেসব তো আসবেই, কিন্তু কেউ কেউ পরিবেশপ্রেমীদের দোষী সাব্যস্ত করলেন। কারণ হিসেবে বলা হল পরিবেশপ্রেমীরা ওখানে নাকি ডিজেল/পেট্রোল চালিত রেসকিউ বোট বা উদ্ধারকারী মোটর চালিত নৌকা চালাতে আপত্তি করে আসছে।
বলে রাখা ভালো যে ক্লাবের হয়ে ছেলে দুটি আরও তিনজনের সঙ্গে প্রবল কালবৈশাখীর হুঁশিয়ারী উপেক্ষা করে বোট নামিয়েছিল। সেই ক্লাবটির কোনো উদ্ধার-ডিঙি কখনোই ছিল না। তাই এখানে পরিবেশপ্রেমীদের কাঠগড়ায় কেন তোলা হল বোঝা গেল না। এখানে ক্লাবের ভারপ্রাপ্ত ‘রোয়িং কক্স’ (শিক্ষক) কেন সেইসময় বোট নামাতে দিলেন ছেলেদের, সে নিয়ে কথা বলার উদ্দেশ্য নয় আমার। কারণ তা পরিবেশ বিষয়ের আওতায় পড়ে না, তাই এবার আসল প্রসঙ্গে ফিরে আসি।
কথা উঠেছে কেন প্রতিটি অনুশীলনের সময় প্রত্যেক বোটের পেছনে একটা করে অনুসরণকারী ডিঙি থাকবে না? কথাটা কতখানি অবিবেচনার ফসল একটু হিসেব করলেই বোঝা যাবে। যে চারটি ক্লাবে রোয়িং চলে তাদের বোটের সংখ্যা প্রায় ২০। সেক্ষেত্রে কটি উদ্ধার-ডিঙির প্রয়োজন আপনারাই বলুন। তাহলে অন্তত একটা উদ্ধার-ডিঙির তত্ত্ব খারিজ হয়ে গেল।
আর দ্বিতীয়ত উদ্ধার-ডিঙির জন্যই দুটি ছেলে মারা গেল এটাও প্রশ্ন চিহ্নের মধ্যে পড়ে। কারণ রোওয়ারদের সাঁতারে কুশলী হতেই হবে। নৌকা উল্টে গেলেও বেশ কিছুক্ষণ ভেসে থাকার ক্ষমতা তাঁর থাকতেই হবে। তবেই তো উদ্ধারের কথা আসবে। যদি একসঙ্গে দুটি নৌকোর দুর্ঘটনা হয় তখন তো সেই আপনা হাত……! এর মধ্যে কি কোনো দ্বিমত আছে? তাহলে উদ্ধার-ডিঙি একমাত্র বিচার্য বিষয় নয়।
সেদিন একটি ছেলে সাঁতার জানতনা আর দ্বিতীয় ছেলেটি তাকে বাঁচাতে গিয়ে এক সঙ্গেই ডুবে গেছিল। বাকি তিনটি ছেলে সাঁতরে তীরে উঠেছিল। এবার বলুন, দোষ পরিবেশপ্রেমীদের? এবার কেউ কেউ যদি পরিবেশের দোহাই দিয়ে সরোবরের মধ্যে পেট্রোল/ডিজেল চালিত কোনো যান চালানোতে আপত্তি করে তার সঙ্গে এই দুর্ঘটনার সম্পর্ক কোথায়?
পরিবেশ আদালতের যে আদেশনামা আছে তাতে ষ্পষ্ট যে সরোবর চত্বরে কোনো জ্বালানিচালিত যান নিষিদ্ধ। সরোবর চত্বর মানে কি শুধু জলের পাশে ডাঙ্গাটুকুই নাকি জলভাগটাও পড়ে? তাছাড়াও কেএমডিএ সম্প্রতি যে নির্দেশ দিয়েছে কোনো ভাবেই ডিজেল বোট চালাতে দেওয়া হবে না, সেটিও কি পরিবেশপ্রেমীদের নির্দেশ? কতটা হাস্যকর এইসব যুক্তি?
এবার আসি জলের আসল চিত্রে। জলের নিচে রয়েছে অতল কাদা আর পাঁক। রয়েছে লম্বা লম্বা ঝাঁঝি যা যে কোন দক্ষ সাঁতারুকেও জালবন্দি করে ডুবিয়ে দিতে পারে। অর্থাৎ এই মুহূর্তে লেকের জল কোনও ক্রীড়ার অনুপযুক্ত। জলে দ্রবীভূত অক্সিজেনের মাত্রাও ক্ষীন। জাতীয় সরোবরের আয়ু শেষ হয়ে আসছে। এখনই এর তলদেশের কঠিন বর্জ্য না তুললেই নয়। এসব ব্যবস্থা না নিয়ে পরস্পরের দোষগুন বিচার করতে থাকলে অচিরেই দক্ষিণ কলকাতার ফুসফুস স্তব্ধ হয়ে যাবে।”